আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল যখন মুখোমুখি অবস্থানে, তখন বাংলাদেশকে ঘিরে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চলছে নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা। নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশের ওপর ইতোমধ্যে বিদেশি চাপ বেড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে এখন দেশে জোর আলোচনা চলছে। শেখ হাসিনা সরকারকে দুর্বল করলে তা ভারত ও আমেরিকার জন্য সুখকর হবে না বলে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত কূটনৈতিক বার্তা দিয়েছে- এমন একটি খবর গত শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের এমন অবস্থান নিয়ে দেশের শহর থেকে গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় সর্বত্র আলোচনা চলছে। চায়ের দোকানগুলোও এ নিয়ে সরগরম। বিষয়টি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া মিলেছে।দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলগুলো। এর বিপরীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যস্ত নির্বাচনী প্রস্তুতি ও বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন মোকাবিলায়। এর মধ্যেই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব কূটনৈতিক তৎপরতাও প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকরা অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সোচ্চার। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্পষ্ট অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী যে কেউ ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে বলে জানানো হয়েছে।ভিসানীতি ছাড়াও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একাধিক মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র; যে বিষয়গুলোতে একমত নয় ভারত। তবে এ নিয়ে ভারতের বলিষ্ঠ কোনো অবস্থানের কথাও জানা যায়নি এতদিন। ফলে ভারতের অস্পষ্ট অবস্থান নিয়ে ভেতরে ভেতরে নানা হিসাব-নিকাশ চলছিল। এর মধ্যেই গত শুক্রবার ভারতীয় গণমাধ্যম আনন্দবাজার ও জার্মানির সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলেসহ কয়েকটি বিদেশি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রকে পাঠানো এক কূটনৈতিক বার্তায় বাংলাদেশ নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে দিল্লি। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, কূটনৈতিক নোটে ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষেই সুখকর হবে না। কারণ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে জামায়াতের মতো সংগঠনের ক্ষমতা বাড়বে বলে মনে করে দেশটি।গণমাধ্যমের খবরে আরও বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতকে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখে, মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে তুলনা করে। কিন্তু ভারত মনে করে জামায়াত একটি উগ্র মৌলবাদী সংগঠন। ভারতের বার্তায় এ কথা স্পষ্ট করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ স্থলসীমান্ত আছে। বাংলাদেশে জামায়াতের মতো দল শক্তিশালী হলে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা সমস্যার মুখে পড়বে। জামায়াতের মতো সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানের নিবিড় যোগ আছে বলেই মনে করে দিল্লি। ভারত জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও চায় বাংলাদেশে অবাধ এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি যে মন্তব্যগুলো করেছে তা বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করে দিল্লি।অন্যদিকে নিরাপত্তা ইস্যুতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশটির অবস্থানটি ভিন্ন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচির মতে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতে দেশটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলবে। পুরো বিশ্ব এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে পারে। কিন্তু ভারত তো ভারতই। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে যা ঘটে, ভারতে তার প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া ভারতের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িত বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের যুগ্ম সচিব (বাংলাদেশ ও মিয়ানমার) স্মিতা পন্ত। এমন প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সরকারের ‘পক্ষে’ যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের কূটনৈতিক বার্তা প্রদানের খবরটি আলোচনার জন্ম দিয়েছে।বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ভারতের এই অবস্থানকে অপ্রত্যাশিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, এ কথাটা আমরা কখনোই বলতাম না, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা দেখতে পাচ্ছি যদি খবরটি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তারা বাংলাদেশের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যদি ভারত কোনো পদক্ষেপ নেয়, সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক।অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের বার্তা দেওয়াকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয় বলে মনে করেন। তিনি বলেন, আঞ্চলিক রাজনীতির বিষয়ে এই ভূখণ্ডে ভারত ও আমেরিকার অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। তাই ভারত আমেরিকাকে কিছু বললে তারা তাদের স্বার্থে বলেছে।এমনই এক বাস্তবতায় আগামী ২২-২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরে অনুষ্ঠেয় ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন এবং আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে শুরু হতে যাওয়া জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিংয়ের সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক হতে পারে। এ ছাড়া দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেবেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন এবং উপমহাদেশের ভূরাজনীতি নিয়ে সমান্তরাল বৈঠক হতে পারে বলে কূটনৈতিক সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে। ভারত জি-২০ সম্মেলনের মঞ্চকে এ বিষয়ে আলোচনার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে বলে খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই বৈঠকগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে।ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে ব্রিকস গঠিত। জোহানেসবার্গে আগামী ২২ থেকে ২৪ আগস্ট অনুষ্ঠেয় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। এই সম্মেলনে ব্রিকসের সদস্য পদ সম্প্রসারণ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে সদস্য পদের মানদণ্ড নির্ধারণে এখনো ব্রিকস ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ব্রিকস ব্যাংকে যোগ দিয়েছে।এই সব বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, একসময় তো ভরতের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল, বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উলফা বা এ ধরনের সংগঠনগুলোর তৎপরতার বিষয় ছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে বর্তমান সরকার ভারতের ওই সব সংগঠনগুলোর তৎপরতার বিষয়ে জিরো টলারেন্সে গেছে। সেই হিসেবে ভারতও মনে করে বাংলাদেশে এমন একটা অবস্থা তৈরি হবে না যে তাদের জন্য ক্ষতিকর সেই সংগঠনগুলো বাংলাদেশে বসে সাহায্য পাবে। আওয়ামী লীগ বললে ভুল হবে, তবে এটা স্বাভাবিক যে ভারতের জাতীয় স্বার্থের কারণে তারা চাইবে না এ দেশে মৌলবাদী কিংবা ভারতবিরোধী শক্তির উত্থান ঘটুক।ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এখন ভারতের জাতীয় স্বার্থ এবং আমেরিকার জাতীয় স্বার্থ আবার যে এক হবে তাও নয়। উভয়ের জাতীয় স্বার্থের মাঝে মৌলিক তফাত আছে। আমেরিকার কথা হলো যদি তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকে, তাহলে কেন চীন, রাশিয়ার সঙ্গে (বাংলাদেশের) সুসম্পর্ক থাকবে? তিনি বলেন, এটা আমেরিকারও বোঝা উচিত যে আমাদের দেশের উন্নয়ন সামান্য উন্নয়ন। এখনই যদি তারা এখানে চাপ দেয় এবং ফলশ্রুতিতে এমন কোনো সরকার আসে, যারা ভারতবিরোধী, তাহলে সেটা তো ভারতও চাইবে না। তখন ভারতের দিক থেকে তো অসুবিধাই। আবার ভারতও বলতে চাচ্ছে তা আমেরিকার জন্যও অসুবিধা হবে। আমি মনে করি, ভারত লেখালেখির মাধ্যমে এটাই বোঝাতে চেয়েছে।নির্বাচন আসন্ন এমন একটি সময়ে ভারতের এই অবস্থান সরাসরি সরকারের পক্ষে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমাদের যে বিভাজন রাজনীতি সেটি তো নতুন নয়। ভারত আসলে বোঝাতে চাচ্ছে যে আমেরিকা এখন মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে চাপ দেওয়ার ফলশ্রুতিতে যদি এমন একটি সরকার আসে যারা ভারতবিরোধী, তাহলে সেটা তো ভারতেরও অসুবিধা। এটাই ভারত পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে তার জাতীয় স্বার্থের জন্য। এ ছাড়া বর্তমান সরকারের সঙ্গে ভারত স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, কারণ বাংলাদেশ বিষয়ে যে নিরাপত্তা বিষয়ক দুশ্চিন্তাগুলো ছিল ভারতের, সেগুলোর অনেকাংশেই এই সরকার দূর করতে পেরেছে। তাই ভারত চাইবেই, যেন এমন সরকার থাকুক, যার কারণে নতুন করে দুশ্চিন্তা তৈরি না হয় এবং এ জন্য তারা ঝুঁকি নিতে চাইছে না। এ ছাড়া এটা নতুন নয়, এটা সবসময়ই দিল্লির নীতি ছিল।
অনলাইন ডেস্ক