বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের পাচার চলছেই, থামছে না। প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, তার প্রায় ৭০-৮০ শতাংশই হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে। ওভার ইনভয়েসিং বা আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো এবং আন্ডার ইনভয়েসিং বা রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানোর মাধ্যমে এসব অর্থ পাচার হয়।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণও বলছে, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সম্পাদনকালে এখনো আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় আজ বুধবার দেশের সব ব্যাংকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই ব্যাংকার্স সভায় আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিং প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন নীতিমালা ২০১৮-এর আওতায় জারি করা সার্কুলারের নির্দেশনা, আমদানি বাণিজ্য সম্পাদনকালে দেশের অথরাইজড ডিলার (এডি) ব্যাংকগুলো কর্তৃক আমদানি পণ্যসমূহের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, তা (আমদানি মূল্যের সঠিকতা) যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ নির্দেশনার আলোকে গত বছরের অক্টোবরে এডি ব্যাংকগুলোকে আমদানি মূল্যের সঠিকতা যাচাই, প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে আমদানি সম্পাদনবিষয়ক রেগুলেটরি বাধ্যবাধকতা পরিপালনের জন্য ফের পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া গত বছরের জুলাই হতে আমদানি ও আমদানি মূল্য পরিবীক্ষণ, জাহাজ ভাড়া, ইনস্টলেশন, কমিশন, ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং, শুল্কায়ন, আমদানিরআড়ালে অর্থপাচার প্রভৃতি দৈনিক ভিত্তিতে যাচাই করা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগের পক্ষ থেকে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত তথ্য ২৪ ঘণ্টা আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, নিয়মিত আমদানি এলসির তথ্য যাচাইকালে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং ওভার ইনভয়েসিংয়ের দৃষ্টান্ত এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে ওভার ইনভয়েসিং আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। তবে আন্ডার ইনভয়েসিং সেভাবে কমানো সম্ভব হয়নি। এটিও কমানোর পন্থা বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে।জানা যায়, গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় আন্ডার ইনভয়েসিং প্রতিরোধে ব্যাংকগুলোকে রপ্তানির তথ্যও যাচাই করার নির্দেশনা দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেই সঙ্গে আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধে উদ্ভাবনী পদ্ধতি বের করার জন্য ব্যাংকগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। জানা গেছে, আজকের ব্যাংকার্স সভায় ওভার ইনভয়েসিংয়ের পাশাপাশি আন্ডার ইনভয়েসিং প্রতিরোধের বিষয়েও জোর দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং ছাড়াও বর্তমানে মাল্টিপল ইনভয়েসিং, শর্ট ও ওভার শিপমেন্ট, ফ্যান্টম শিপমেন্ট এবং ডিসকাউন্ট অথবা পণ্যমূল্য পরিবর্তনের মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যভিত্তিক মনিলন্ডারিং সংঘটিত হয়ে থাকে। এর বাইরে হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থপাচার হচ্ছে।অর্থপাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে অর্থায়ন প্রতিরোধে কাজ করে দেশের কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির উদ্যোগে বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও ভ্যাসেল ট্র্যাকিং বিষয়ে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের অগ্রগতি বাস্তবায়নে গঠিত কমিটির গত বছরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে বাণিজ্যভিত্তিক মানিলন্ডারিংয়ের প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় পণ্য বা সেবার মূল্য প্রভৃতি পরিশোধের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কি পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার ধারণা পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রতিবেদন থেকে। সর্বশেষ ২০২১ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের পরে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ বেড়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৮৭ কোটি ১০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে। ২০০৯ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫২১ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৬৮৪ কোটি ডলার, ২০১১ সালে ৮৭৩ কোটি ডলার, ২০১২ সালে ৭৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার ও ২০১৩ সালে ৯৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচার করা হয়। সব বিলে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১৪ বাদে) ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৫ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা।
তবে গত বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেছে। যদিও একই সময়ে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থ জমার পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত জুনে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। এর মধ্যে ৩ কোটি ৫৬ লাখ ব্যক্তিপর্যায়ের। যা ২০১৬ সালের পর সর্বোচ্চ। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ।
আরও যা আলোচনা হবে ব্যাংকার্স সভায় : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইমপোর্ট অনলাইন মনিটরিং সিস্টেম (ওআইএমএস) ও এক্সপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমে (ওইএমএস) ব্যাংকগুলোকে যথাসময়ে নির্ভুলভাবে তথ্য দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হবে। ব্যাংকগুলোর ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে ক্লাটারভিত্তিক অর্থের জোগান বৃদ্ধি এবং খেলাপি ঋণ সংশ্লিষ্ট মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির মাধ্যমে আদায় ত্বরানি¦ত করার বিষয় আলোচনা হবে। এ ছাড়া বিবিধ আলোচনায় গত জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া ঋণের সুদহারের স্মার্ট পদ্ধতি এবং এবং আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে টাকা ও ডলারের ইউনিফর্ম এক্সচেঞ্জ রেট বাস্তবায়ন নিয়েও আলোচনা হবে।
সারাদেশ