ঝালকাঠিতে ছয় র্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে কলেজছাত্র লিমন হত্যাচেষ্টা মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে লিমনের মা হেনোয়ারা বেগমের নারাজি গ্রহণ করে মামলাটি পুনঃতদন্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বুধবার দুপুরে নারাজি আবেদনের শুনানি শেষে ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক এএইচএম ইমরানুর রহমান এ আদেশ দেন।
আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
লিমনের মায়ের পক্ষে আদালতে শুনানি করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্র নিয়োজিত লিমনের মায়ের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আক্কাস সিকদার।
মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বরিশাল র্যাব-৮ এর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় তৎকালীন কলেজছাত্র লিমন হোসেন গুলিবিদ্ধ হয়। পরবর্তীতে লিমনের বাম পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলেন পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা। এ ঘটনায় লিমনের মা বাদী হয়ে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল তৎকালীন সময়ে বরিশাল র্যাব-৮ এর ডিএডি লুৎফর রহমান, কর্পোরাল মাজহারুল ইসলাম, মো. আব্দুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক প্রহল্লাদ চন্দ ও সৈনিক কার্তিক কুমার বিশ্বাসসহ আরও অজ্ঞাতনামা ছয় র্যাব সদস্যর নামে ঝালকাঠির আদালতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি রাজাপুর থানার এসআই আব্দুল হালিম তালুকদার তদন্ত করেন ২০১২ সালের ১৪ আগস্ট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে র্যাব সদস্যদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন। লিমনের মা হোনোয়রা বেগম ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে নারাজি দাখিল করেন।
আদালত ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তার নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন। নারাজি খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ রিভিশন দায়ের করেন হেনোয়রা বেগম। ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এসকেএম তোফায়েল হাসান রিভিশন মঞ্জুর করেন।
রিভিশন মঞ্জুর হওয়ার পর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. সেলিম রেজা মামলাটি তদন্তের জন্য ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল পিবিআইকে নির্দেশ দেন। দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে পিবিআই প্রধান কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. আমিনুল ইসলাম ২০২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে আবারো পুলিশের মতো চূড়ান্ত প্রতিবেদন (সত্য) দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে পিবিআই উল্লেখ করেন, লিমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা সত্য, তবে কারা তাকে গুলি করেছে তার কোনো সাক্ষী প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতে সাক্ষী প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করা হবে। এ কারণে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
এই চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম আদালতে ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর নারাজি দাখিল করেন।
লিমনের মায়ের দাবি, তার ছেলে কোনো সন্ত্রাসী ছিল না। একটি ভালো ছেলেকে র্যাব গুলি করে তাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এ ঘটনার তিনি সুষ্ঠু ও সঠিক বিচার দাবি করেন।
উল্লেখ্য, র্যাবের কথিত বন্দুক যুদ্ধে এক পা হারানো লিমন হোসেন ২০১৩ সালে এইচএসসি, ২০১৮ সালে আইন বিষয়ে অনার্স, ২০১৯ সালে এলএলএম পাশ করেন। ২০২০ সালে লিমন হোসেন সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। ২০২২ সালে লিমন যশোরের অভয়নগর থানার এক কলেজছাত্রীকে বিবাহ করেন।
লিমন হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, র্যাব অন্যায়ভাবে আমাকে গুলি করে পঙ্গু করেছে। আমি অনেক কষ্ট করে মানুষের ভালোবাসায় পড়ালেখা শেষ করেছি ঠিকই কিন্তু আমার পা হারানোর কষ্ট ভুলতে পারছি না। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন যারা আমাকে পঙ্গু করেছে তাদের বিচার দাবি করব।
২০১১ সালে ঘটনার পর লিমনকে সন্ত্রাসী দাবি করে র্যাব লিমনসহ আটজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে এবং সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেছিল সেই দুটি মামলাতেই লিমনসহ সব আসামিরা আদালত থেকে ২০১৮ সালে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।
ঘটনার শুরু থেকে লিমনকে আইনি সহায়তা দিচ্ছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং ঝালকাঠির কয়েকজন আইনজীবী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র নিয়োজিত লিমনের মায়ের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আক্কাস সিকদার বলেন, ঘটনার পর রাজাপুর থানা পুলিশ লিমন হত্যাচেষ্টা মামলা তদন্ত করে চূড়ান্ত রিপোর্ট (তথ্যগত ভুল) দাখিল করে র্যাব সদস্যদের অব্যাহতির সুপারিশ করে এবং লিমনসহ পুরো পরিবারকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে।
অপরদিকে পিবিআই প্রায় চার বছর তদন্ত করে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট (সত্য) দাখিল করে। পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা রিপোর্টে লিমনকে একজন শান্তশিষ্ট ছাত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, র্যাব এবং সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির মধ্যে লিমন গুলিবিদ্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু কে তাকে গুলি করেছে তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, আসলে পিবিআই তদন্ত করে আসল ঘটনা জানতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের তদ্বিরে চূড়ান্ত রিপোর্ট দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে আমার কাছে রিপোর্টটি সত্যের কাছাকাছি মনে হয়েছে। কোনো সংস্থার কাছ থেকে আমরা ন্যায়বিচার না পেলেও হাইকোর্ট থেকে একদিন ন্যায়বিচার ঠিকই পাব।
ঝালকাঠী