বরিশাল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক ও প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট এসএম ইকবাল আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ওইন্নালিল্লাহি রাজিউন)।
আজ বিকেলে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার সম্পাদিত দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল পত্রিকার বার্তা সম্পাদক প্রিন্স তালুকদার।
জেনে নিন কে এই এস.এম.ইকবাল :
৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বরিশালে সাংবাদিকতায় আলো ছড়িয়েছেন এ্যাড এসএম ইকবাল। সাংবাদিকদের বিপদে-আপদে তাকে ডাকতে হয় না, নিজেই এসে হাজির হন। দুঃসময়ে পাশে থেকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেন। এমন একজন পরোপকারী ব্যক্তি হলেন সাংবাদিক এস এম ইকবাল।
এছাড়াও তিনি একাধারে সাংবাদিক, আইনজীবী, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষানুরাগী সমাজসেবক ও সংগঠক। তবে সবচেয়ে বড় কথা, সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে একজন পরোপকারী সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, পদ-পদবি ও ক্ষমতার কথা ভাবেননি কখনও। কোনো যশ, খ্যাতি কিংবা পদের মোহ তার ছিল না। সৎ ও নির্লোভ মানুষ হিসেবে বরিশালের সাংবাদিক জগতে তার সুনাম রয়েছে। যেমনি সাংবাদিকতায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তেমনি শিক্ষা ও সামাজিক ক্ষেত্রেও অসামান্য অবদান রেখেছেন এস এম ইকবাল। তার প্রচেষ্টায় তার এলাকায় স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৭৯ বছরের দীর্ঘ জীবনে ৫০ বছর ধরে সক্রিয় এস এম ইকবাল সাংবাদিকতায় এক নিবেদিত প্রাণ। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এস এম ইকবাল কখনও সাংবাদিকতা পেশার উন্নয়নে কাজ করেছেন, কখনও জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
এস এম ইকবাল ১৯৪৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার লবনসাড়া গ্রামের এক ধর্মপ্রাণ সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সৈয়দ শামসুল হুদা এবং মায়ের নাম ফরিদা বেগম। প্রারম্ভিক শিক্ষাজীবনে ৩য় শ্রেণিতে বরিশাল জিলা স্কুলে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন।
১৯৬৪ সালে বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন এস এম ইকবাল। স্বাধীনতার পরে সংস্কৃত সাহিত্যে কাব্যতীর্থ এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করেন তিনি।
ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষাজীবন থেকে রুচিশীল এবং আধুনিক চিন্তার এ মানুষটি তার স্বপ্ন পূরণে যোগ দেন সেই সময়ের শক্তিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা বরিশালের সন্তান সাদেক খানের চলচ্চিত্র নির্মাণ সংস্থা ‘লুব্ধক ফিল্ম’-এ। কারওয়া, নদী ও নারী, আকাশের রং নীল, ক্যায়সে কাহু নামক সময়ালোচিত চলচ্চিত্রগুলোতে কাজ করেন সহকারী প্রোডাকশন কন্ট্রোলার হিসেবে। এফডিসির সেই সময়ের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র সম্পাদক আবদুর রহমান আদরের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
এরপরে ধর্মপ্রাণ পরিবারের সন্তান এস এম ইকবাল বাবা ও চাচার নির্দেশে চলচ্চিত্রের রঙিন জগৎ ছেড়ে মনে অভিমান চেপে ফিরে আসেন বরিশালে। এখানে এসে গড়ে তোলেন সামাজিক সংগঠন ‘বরিশাল যুব সংঘ’। নাটক রচনা ও মঞ্চায়ন, আবৃত্তি, খেলাধুলাসহ সকল সামাজিক ক্ষেত্রে কাজ করতো এ যুব সংঘ।
১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সমরাস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ না পেয়ে এ যুব সংঘের সদস্যরা নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র উদ্ভাবন করেন। বরিশাল শহরের সদর রোডের একটি ঘরে যুব সংঘের কর্মকাণ্ড চলতো। পরে কালিবাড়ি রোড ধর্মরক্ষিণী ভবনে গোপনে এ যুব সংঘের সদস্যরা বোমা বানানোর কাজ শুরু করেন। যুব সংঘ মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলাযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখে।
এ সময়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম পত্রিকা, যার নাম ‘বাংলাদেশ’। এস এম ইকবাল এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের উপর প্রকাশিত দলিলের ৬ষ্ঠ খণ্ডে উল্লেখ রয়েছে।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধকালীন লুণ্ঠিত সম্পদের হিসাব সংরক্ষণের দায়িত্ব পায় যুব সংঘ। যার সরাসরি নেতৃত্বে ছিলেন এস এম ইকবাল। সাহিত্য সচেতন এস এম ইকবাল ১৯৭২ সালে কলকাতার সাহিত্য গবেষক দিলীপ কুমার দাসের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেন জীবনানন্দ দাশ এর ‘রূপসী বাংলা’। তখন জীবনানন্দ দাশের রচনাবলী খুব বেশি সংখ্যক মানুষের সংগ্রহে ছিল না।
সেই থেকে শুরু, তারপর থেমে থাকেননি। একে একে সম্পাদনা করতে থাকেন জীবনানন্দ দাশ এর ‘বনলতা সেন’, ‘সুরঞ্জনা’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘সুকান্তের ঘুম নেই’ ইত্যাদি গ্রন্থ। এছাড়া মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে ‘ছোটদের নজরুল’, ‘ছোটদের রবীন্দ্রনাথ’, ‘ছোটদের শরৎচন্দ্র’সহ প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ।
১৯৭৩ সালে জনসমর্থনে নির্বাচিত হন বরিশাল পৌরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার। ১৯৭৪ সালে দু’বার দায়িত্ব পালন করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে। ১৯৮৫ সালে বানারীপাড়া উপজেলার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
পদাধিকার বলে বানারীপাড়া উপজেলার ২৭টি বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। এই শিক্ষানুরাগী মানুষটি বাইশারীতে একটি স্কুল ও একটি কলেজ নির্মাণ করেন।
বরিশালের ইতিহাসে আরও একটি আবেগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছে এস এম ইকবালের নাম। বরিশালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটির অন্যতম শক্তিমান ও পরিশ্রমী সদস্য এ আজন্ম অসাম্প্রদায়িক মানুষটি। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব এবং পরবর্তী বরিশালের গল্পকথা যিনি সব থেকে সাংগাঠনিকভাবে তুলে ধরতে পারেন আধুনিকতম শব্দচয়নে তার নাম অ্যাডভোকেট এস এম ইকবাল।
এসএম ইকবাল অমর একুশের গান হিসেবে খ্যাত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র সুরকার সংস্কৃতিকর্মী ও স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদের নামে ১৯৭২ সালে বরিশালে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘শহীদ আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যালয়।
বর্তমানে তিনি বিদ্যালয়টির সভাপতি। এছাড়া ২৮টি সংগঠনের জোট বরিশাল সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয় পরিষদের তিনি দু’বার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে তিনি উদীচী বরিশাল জেলা সংসদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য অর্ধশতাধিক সংগঠন তাকে গুণীজন হিসেবে সম্মননা দিয়েছেন।
বরিশাল জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে জেলার শ্রেষ্ঠ কমিউনিটি পুলিশের সদস্য হিসেবে আইজিপি পদক প্রদান করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
সাংবাদিক হিসেবে বরিশালের সংবাদ জগতে আলোকিত নাম এস এম ইকবাল। সত্তরের দশক থেকে তিনি এ পর্যন্ত ঢাকা ও বরিশাল থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। এ সময়কালে তিনি বাংলাদেশ, জনপথ, বিপ্লবী বাংলাদেশ, বাংলাদেশ টাইমস, দৈনিক দেশ, নিজের সম্পাদনায় ‘কথা’, বরিশাল থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজকের বার্তা’র সম্পাদক ও সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দৈনিক দক্ষিণাঞ্চল পত্রিকার সম্পাদক ও বরিশালের আজকাল পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন।
বরিশাল প্রেসক্লাবের ৮ বার নির্বাচিত সভাপতি ও ৫ বার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন এস এম ইকবাল। সাংবাদিকতায় মাইনুল হাসান স্মৃতি পদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এ সাংবাদিক।
অ্যাডভোকেট এস এম ইকবাল বরিশালের এমন এক উজ্জ্বলতম নাম যিনি আইন পেশাকে পেশা হিসেবে দেখেননি কখনও। সাংবাদিক, অসহায়, গরিবদের জন্য আইনি লড়াই করতেই নিজেকে আইন পেশায় নিয়োজিত রেখেছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হলে পাশে গিয়ে পরম বন্ধুর মতো দাঁড়িয়েছেন অ্যাডভোকেট এস এম ইকবাল। নিজ খরচে তাদের মামলা লড়েছেন। বিপদে-আপদে যেমন পাশে থাকেন তেমনই সঠিক দিক নির্দেশনা দেন চলার পথের। পরোপকারী হিসেবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন এস এম ইকবাল।
বরিশালে শোকের ছায়া :
এই কর্মবীরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বরিশালজুড়ে। শোক প্রকাশ করেছেন মন্ত্রী আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম, বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ, শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াত বরিশাল প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী নাসির উদ্দিন বাবুল, বরিশাল টেলিভিশন মিডিয়া এসোশিয়েশন, বরিশাল মেডিমেল রির্পোটারস্ অ্যাসোসিয়েসন সহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠন গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
লিড নিউজ বরিশাল, লাইফস্টাইল, শিরোনাম, সারাদেশ, হোম