প্রথমে দেখলে যে কারো মনে হবে এ যেন এক অসুস্থতার প্রতিযোগিতা। অসুস্থ কেউ, অন্য কাউকে স্পর্শ করলেই তিনিও হচ্ছেন অসুস্থ। তবে কী কারণে অসুস্থ হচ্ছেন তা এখনো সবার কাছেই অজ্ঞাত এক আতঙ্ক।
এমনই এক ঘটনা ঘটেছে বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বুধবার সকালে ওই বিদ্যালয়ে আসা শিক্ষার্থীরা একের পর এক অসুস্থ হতে শুরু করে। তবে কেন অসুস্থ হচ্ছে, কেনই বা অস্বাভাবিক আচরণ করছে তার কিছুই বলতে পারে না শিক্ষার্থীরা।
এক কথায় অজ্ঞাত কারণে আতঙ্ক। এ ঘটনায় অসুস্থ শিক্ষার্থীরা অনেকেই চিকিৎসা নিয়েছে হাসপাতালে, বাকিদের অভিভাবকদের মাধ্যমে নিজ নিজ বাড়িতে পাঠান বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত দুই দিন যাবৎ ওই বিদ্যালয়ে ঘটছে এমন বিস্ময়কর কাণ্ড।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে দেখা যায়, একে একে প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থী মুহূর্তেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কেউ কান্না করছে, কেউ আবার চিৎকার দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে, আবার কেউ কেউ জ্ঞান হারিয়ে শ্রেণিকক্ষের মেঝেতেই লুটিয়ে পড়েছে। একজন অন্যজনকে স্পর্শ করলেই দ্বিগুণ মাত্রায় বাড়ছে অসুস্থতা। বাস্তবে দেখলে যে কেউ মনে করবে কোনো আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাবে হচ্ছে সবকিছু।
শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে- সপ্তম শ্রেণির হাবিবা, মরিয়ম, সুমাইয়া, অষ্টম শ্রেণির কুলসুম, চাঁদনী, নবম শ্রেণির শামিমা, জান্নাতি, আরিফা ও দশম শ্রেণির মীম, হাফিজা, নাবিলা।
এদের মধ্যে কয়েকজন দুপুরের দিকে কিছুটা সুস্থ হয়। তারা কিভাবে অসুস্থ হলো জানতে চাইলে বলে- আমরা হঠাৎ করে নিজেকেই নিজে চিনতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল কেউ আমাদের তাড়া করছে। অন্যদিকে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়েছি এমন খবর পেয়ে আমাদের অভিভাবকরা বিদ্যালয়ে এলে দুই-একজন ব্যতীত অনেকেই আমরা তাদের চিনতে পারিনি। এছাড়া তাদের তেমন কিছু মনে নেই বলে জানান।
তবে অসুস্থ হওয়া শিক্ষার্থীরা সবাই সপ্তম থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী, এর মধ্যে একজন ছাত্রও অসুস্থ হয়নি। ফলে বিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা ঘটনাটিকে রহস্যময় বলেই আখ্যা দিচ্ছেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এ ঘটনার কোনো সঠিক কারণ খুঁজে পাননি।
তবে ঘটনার সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে- এমনটাই জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নান্না মিয়া।
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে বিদ্যালয়ের সব শ্রেণিকক্ষ এন্টিসেপটিক দিয়ে পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে যতটুকু জানতে পেরেছি এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। এ সময় শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে বুঝিয়ে শান্ত রাখাটাই উত্তম।
এদিকে বিদ্যালয়ের অন্যান্য সুস্থ শিক্ষার্থীরা দিচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা। তারা বলছে- বিদ্যালয়ে আকস্মিকভাবে কোনো অলৌকিক শক্তির প্রভাব পড়েছে। যার ফলে অসুস্থতার পরপরই কেউ কেউ উলটাপালটা কথাবার্তাও বলছে। আবার কেউ বলছে ছাত্রীদের জন্য নির্ধারিত স্থান নন্দিনী কর্নারের কক্ষে প্রবেশের পর থেকেই ওই শিক্ষার্থীদের এমন অস্বাভাবিক আচরণ ও শারীরিক অস্বস্তি শুরু হয়। এরপরই শুরু হয় ছোটাছুটি। একে একে অসুস্থ হয় অন্তত ২৫ জন, শুধু আজকে না গতকালও ৮-১০ জন শিক্ষার্থী এমনভাবে অসুস্থ হয়েছে।
তবে এ ব্যাপারে চিকিৎসা বিজ্ঞান কী বলছে জানতে কথা হয় বরিশাল শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের (মেডিসিন বিভাগের) ইনডোর মেডিকেল অফিসার ডা. রবীন্দ্রনাথ সরকারের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এমন অজ্ঞাত কারণে অসুস্থতার ঘটনা অনেক সময় ঘটে, তবে এটি কোনো ধরনের অলৌকিক বিষয় নয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ সমস্যার একটি সুন্দর ব্যাখ্যা আছে। এটির বাংলা অক্ষরিক নাম গণমনস্তাত্বিক অসুস্থতা বা (ম্যাস হিস্টিরিয়া)।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই (কিশোর—কিশোরী) বয়সের মধ্যে এমন প্রভাব বেশি দেখা যায়, আবার এ সমস্যা অন্য যে কারও হতে পারে। এমন সময়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ওই সকল কিশোর—কিশোরীদের কাউন্সেলিং বা মনোবিকলন করা। তদের এটা বুঝাতে হবে তারা যা দেখছে বা ভাবছে, সেটি সম্পূর্ণ অবাস্তব একটি বিষয়।
সারাদেশ