অনলাইন ডেস্ক ।। বরিশালে যে মাদকের প্রসার ঘটেছে বা বিক্রেতাদের আনাগোনা বেড়েছে, তা পুলিশের কয়েকদিনের অভিযানই জানান দিয়েছে। শীর্ষস্থানীয় কতিপয় মাদকবিক্রেতা গ্রেপ্তারসহ তাদের কাছ থেকে ইয়াবা বা গাঁজার বড় চালান উদ্ধার বরিশাল মাঠপুলিশের জন্য স্বস্তিদায়ক হলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তৎপরতা আরও বৃদ্ধি করতে চাইছে। ফলে মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তারা যতটা না দৌড়ের ওপর আছেন, তার চেয়ে ঢের দৌড়াচ্ছেন মাদকবিক্রেতারা। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত সপ্তাহের শেষ দিকে বরিশাল মেট্রোপলিটন আওতাধীন এলাকাসমূহের মাদক স্পটগুলোতে ধারাবাহিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। এর পরপরই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা নিজেদের আত্মরক্ষার্থে অনেকটা বেচা-বিক্রি বন্ধ করে অন্তর্ধান হয়ে যায়।
অবশ্য বিভিন্ন মাধ্যম এই বিষয়টি মাঠপুলিশ নিশ্চিত হলেও মাদকবিরোধী অভিযান এবং ব্যবসায়ীদের টুটি চেপে ধরতে তারা হার্ডলাইনে রয়েছেন। জানা গেছে, চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে যাওয়ার সুযোগে বাড়তি আয়ের ধান্দায় বেশ কিছু যুবক নেশাদ্রব্য বিক্রিতে সক্রিয় হয়, তাদের একজন মো. ফয়েজ আহমেদ। তার গ্রামের বাড়ি বাকেরগঞ্জ উপজেলায় হলেও তিনি বরিশাল নগরীর ২০ নং ওয়ার্ডের বিএম কলেজ রোডস্থ ফিরোজা মঞ্জিলের ভাড়াটিয়া। কোতয়ালি মডেল থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আরাফাত রহমান হাসানের নেতৃত্বে একটি টিম ফয়েজকে গতকাল শুক্রবার রাতে প্রথমে শহরের ১২ নং ওয়ার্ডস্থ তোরাব আলী খান সড়ক থেকে ২০২ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে। এবং পরবর্তীতে তার দেওয়া স্বীকারোক্তি অনুসারে বিএম কলেজ এলাকার ভাড়াটিয়া বাসা থেকে আরও ২০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
কোতয়ালি থানা পুলিশের সূত্র জানায়, গত সপ্তাহের শেষ দিকে অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘বরিশালটাইমস’ পত্রিকায় মাদকসংক্রান্ত বেশ কয়েকটি সংবাদপ্রকাশ হয়। এই খবরে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেছেন এবং মেট্রোপলিটন আওতাধীন এলাকাসমূহের সকল মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণে নির্দেশনা দিয়েছেন। মূলত সেই নির্দেশানার আলোকেই মাঠপুলিশ তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে, প্রতিদিনই ধরছে কোনো না কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে।
কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই অভিযানে রাঘব-বোয়াল অর্থাৎ যারা মাদকের মজুত করে থাকেন তাদের অধিকাংশই থেকে যাচ্ছে ধোরাছোয়ার বাইরে। পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, শীর্ষ কর্মকর্তা গত সপ্তাহে মাঠপুলিশকে মাদকবিক্রেতাদের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাগ্রহণ করতে বলেছেন, তাতে মাদকসংশ্লিষ্টদের মধ্যে থরকম্প সৃষ্টি করেছে। এই তথ্য কোনো মাধ্যম আগাম প্রাপ্ত হয়ে নিজেদের সেইভ সাইডে রাখতে চিহ্নিত অনেক বিক্রেতা গাঢাকা দিয়েছেন।
অবশ্য এই তথ্য বরিশাল শহরের কজন মাদকবিক্রেতা ঘনিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করে বলছে, মেট্রোপলিটন পুলিশ যেভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের টুটি চেপে ধরছে, তাতে কারওই রক্ষা নেই (!) মূলত এমন ধারনা অনুমানে এনেই ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশ বরিশাল ত্যাগ করে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে আছেন।
সূত্রগুলো জানায়, বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরা যখন পুলিশের ধাওয়ার ওপর রয়েছেন, ঠিক তখনই নয়া কিছু বিক্রেতা সুযোগ বুঝে মাঠে নেমেছেন। তাদের অনেকে বেচা-বিক্রির শুরুতেই পুলিশের খাচাবন্দি হচ্ছেন, পরবর্তীতে যাচ্ছেন কারাগারে। মেট্রো আওতাধীন কোতয়ালি, কাউনিয়া, বিমানবন্দর এবং বন্দর থানা পুলিশ বর্তমানে মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার ও নেশাদ্রব্য উদ্ধারে এখন যতটা আন্তরিক, তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে একটা সময় এই অবৈধ বাণিজ্য কিছুটা হলেও রোহিত করা সম্ভবপর হবে।
পর্যবেক্ষক মহল বলছে, মাদক প্রশ্নে শুধু মেট্রোপলিটন পুলিশ নয়, জেলা পুলিশ এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকল ইউনিটের তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ হালসময়ে বরিশালে মাদকের বড় যে চালানগুলো আসছে, তার অধিকাংশই নৌপথে। এর জন্য জেলা পুলিশকে স্ব-স্ব থানাসমূহে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সৎ-স্বচ্ছ থাকতে হবে। নতুবা এই অঞ্চলে মাদকের অবাধ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। প্রয়োজনে মাদক ইস্যুতে মেট্রো ও জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের এক টেবিলে বসে মাদকবিরোধী অভিযানের কঠোর সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
অবশ্য পর্যবেক্ষক মহলের এমন পরামর্শকে কোনোভাবে ইগনর করছেন না শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, জেলা বা মেট্রোপলিটন পুলিশের মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই, যেখানেই মাদকের সন্ধান মিলছে সেখানেই অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। অনেক সময় দেখা যায়, নেশাদ্রব্যসহ এক ব্যবসায়ী বরিশাল নগরী থেকে গ্রেপ্তার হলেন এবং তিনিই পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন তার বাড়ি জেলার অন্য থানাধীন। পুলিশ কিন্তু সেই ব্যবসায়ীকে নিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট থানার সহযোগিতায় সেখানেই অভিযান চালাচ্ছে, উদ্ধার করছে মাদক। মোদ্দা কথা হচ্ছে, মাদক ইস্যুতে বরাবরই পুলিশ জিরো ট্রলারেন্সে ছিলো, এখনও আছে।
পুলিশ এত সতর্ক থাকার পরেও কেন মাদক নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না- এমন প্রশ্নে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, মাদক রোধ করতে হলে আগে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। মাদকের ভয়াবহতা মানুষের মধ্যে তুলে ধরার পাশাপাশি আইন সম্পর্কেও অবহিত করা জরুরি। এটা করতে পারলে পুরোপুরি না হলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
প্রাসঙ্গিক এই বিষয়ে বরিশাল কোতয়ালি মডেল থানা পুলিশের ওসি মো. আনোয়ার হোসেন বলছেন, মাদক ইস্যুতে কোনো ছাড় নেই। প্রতিদিনই ২/৪ জন তাদের জালে আসছে, উদ্ধার হচ্ছে ইয়াবা, ফেন্সিডিল নতুবা গাঁজা। সৎ অফিসার হিসেবে খ্যাতিপ্রাপ্ত এই পুলিশ কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন, গত সপ্তাহের শেষ দিকে সাতদিনের একটি মাদকবিরোধী অভিযান চললেও চিহ্নিত ব্যবসায়ীরা আছেন ধোরাছোয়ার বাইরে। তাদের ওপর মেট্রোপলিটন আওতাধীন সকল থানা পুলিশের সতর্ক নজর আছে, কিন্তু তারা অভিযানের এই সময় অনেকেই বরিশালের বাইরে আছেন।
এই সুযোগে নয়া ব্যবসায়ী সৃষ্টি হয়েছে, যাদের মধ্যে কজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারও হয়েছেন এমন প্রশ্নে ওসি বলেন তথ্য অমূলক নয়। এই গতকাল রাতে এসআই আরাফাত হাসান বিএম কলেজ এলাকা থেকে ফয়েজ নামের যে বিক্রেতাকে গ্রেপ্তার করেছেন, তিনি নব্য মাদক ব্যবসায়ী।
এসআই আরাফাত রহমান হাসানও একজন কর্তব্যপরায়ণ এবং সৎ-চৌকশ কর্মকর্তা হিসেবে সমাধিক পরিচিত। তিনিই ফয়েজকে ৪০২ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করেন। এছাড়া দুদিন পূর্বে থানা পুলিশের অরপর কর্মকর্তা রাকিব হোসাইনও ভালো একটি পারফম করছেন, তিনি ইয়াবার বিশাল একটি চালানসহ কয়েকজন বিক্রেতাকে পাকড়াও করেন।
এসআই রাকিব জানান, ২৬ নং ওয়ার্ডের উত্তর জাগুয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬ হাজার ৪০০ পিস ইয়াবাসহ সুমন নামের ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেন। প্রথমে তাকে বাসার সম্মুখ থেকে ১০০০ পিস এবং পরক্ষণে তার দেওয়া তথ্যে বাসা অভ্যন্তর থেকে আরও ৫ হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
ওসি আনোয়ার হোসেন বলছেন, মাদক উদ্ধারে পুলিশ যে আন্তরিকতার সাথে তৎপরতা চালাচ্ছে, তা কদিনের অভিযানিক পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যায়। এই কর্মকর্তা জানান, থানা পুলিশের অন্তত ৩ টিম সর্বদা প্রস্তুত থাকছে মাদক উদ্ধার অভিযানে।
মাদক ইস্যুতে কোনো আপস নয়, এমন বার্তা দিয়েছেন বরিশাল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এনায়েত হোসেনও। সহকারি পরিচালক পদমর্যাদার এই কর্মকর্তা বলেন, তারা শুধু বরিশাল নগরীতে নন, জেলার সকল থানাসমূহে অভিযানের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। এতে তারা সফলও হচ্ছেন বলে দাবি করেছেন। এবং উদাহরণস্বরুপ দেখাচ্ছে এক পক্ষকালের বেশ কয়েকটি বড় অভিযানের পরিসংখ্যান। অবশ্য এই কর্মকর্তার কথার সাথে কাজেরও মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তার নেতৃত্বে গত সপ্তাহের শেষ দিকে দ্বীপ উপজেলা মেহেন্দিগঞ্জ থেকে গাঁজার এক মণের একটি বিশাল চালানসহ দুজনকে ধরা হয়। জানা যায়, ওই মাদকের চালানটিও বরিশালের বেলতলাতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা ছিল ব্যবসায়ীদের। কিন্তু লক্ষীপুর থেকে পারিজাত লঞ্চে সেটি বরিশালে পৌঁছানোর আগেই মেহেন্দিগঞ্জে ধরে ফেলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
সবকিছু মিলিয়ে মাদক উদ্ধার এবং বিক্রেতাদের টুটি চেপে ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ইউনিটগুলো যে তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে তা আর বলার অপেক্ষা নেই। কিন্তু তারপরেও বিভাগীয় শহর বরিশালে মাদকের এত বিস্তার ঘটলো কী সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।
এমন প্রশ্নে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার (অতিরিক্ত আইজিপি) মো. সাইফুল ইসলামের ভাষ্য হচ্ছে, মাঠপুলিশকে সর্বদা মাদক ইস্যুতে জিরো ট্রলারেন্সে থাকতে বলা হয়েছে, তারাও সেটি করছে। সাতদিনের একটি অভিযান চলছে, এতে কয়েকে গ্রেপ্তার হচ্ছে, হয়েছেন। পর্যায়ক্রমে অভিযানের ব্যপ্তি আরও বৃদ্ধি করা হবে।
সৎ-স্বচ্ছ মানসিকতার এই কর্মকর্তার সাথে মুঠোফোনে নাতিদীর্ঘ আলাপচারিতায় যে আভাস পাওয়া গেলো, তাতে বোঝা যায় তিঁনিও মাদক ইস্যুতে পুরোপুরি হার্ডলাইনে আছেন। এবং চলমান এই মাদকবিরোধী অভিযান তিঁনি নিজেই মনিটরিং করছেন। এমন পরিস্থিতিতে মাঠপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা যে গাফলতি করবেন, তারও সুযোগ নেই।
পুলিশ কমিশনারের এমন কঠোরতা এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাড়াশি অভিযানের সার্বিক প্রেক্ষাপট বরিশালের চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে চিহ্নিত অনেকে নিরাপদ স্থান বেঁচে নিয়ে আত্মরক্ষা করছেন। এই সুযোগে বিএম কলেজ এলাকার নতুন ব্যবসায়ী ফয়েজদের মতো অনেকের আবির্ভাব ঘটলেও তাদের দমনে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যেমন এই ত্রিশোর্ধ্ব যুবকের ব্যবসা শুরুতেই তার লাগাম টেনে ধরলেন কোতয়ালির এসআই আরাফাত রহমান হাসান।
লিড নিউজ বরিশাল